আমার মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা স্কুল থেকে ফিরে সেদিন হঠাৎ খুব নিবিষ্ট হয়ে গুগল ঘাটছিল।

 মাত্র দুই মাস আগের একটি ঘটনা। আমার মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা স্কুল থেকে ফিরে সেদিন হঠাৎ খুব নিবিষ্ট হয়ে গুগল ঘাটছিল। দীর্ঘক্ষণ আমার ল্যাপটপ নিয়ে গুগলে ব্যস্ত, যা সচরাচর করে না। কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় প্রথমে বলছিল না। শেষে নিজেই জানতে চাইল,

"বাবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কাজী নজরুল ইসলামকে ওষুধ খাইয়ে অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছিল?"
কোথায় শুনলে?
ক্লাসের মিস বলেছে।
আর কি কি বলেছে?
তিনি বলেছেন, "কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। তিনি বিশ্বকবি হতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ষড়যন্ত্র করে হতে দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের সঙ্গে তার বোনের বিয়ে দিয়েছিল। সেই মহিলার মাধ্যমে ওষুধ দিয়ে নজরুল ইসলামকে অসুস্থ বানিয়ে দেয়।"
জিজ্ঞেস করলাম, "কোন টিচার বলেছে?"
মিসের নাম বলল। তার টেলিফোন নাম্বার সংগ্রহ করে কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলাম,
"আপা, আপনি কি আজ ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের রবীন্দ্রনাথ এবং কাজী নজরুল ইসলামের জীবন কাহিনী পড়িয়েছেন?"
তিনি বললেন, কথা প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি।
কি আলোচনা করেছেন?
কেন ভাই?
আপনি কি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুলকে মানসিক অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছিলেন যাতে নজরুল বিশ্বকবি হতে না পারেন?
তিনি অস্বীকার করলেন। কথার একপর্যায়ে বললেন, "আমি শুধু বলেছি, "রবীন্দ্রনাথ তার বোনের সঙ্গে কাজী নজরুলের বিয়ে দিয়েছিলেন।"
আমি আমার কন্ঠে সবটুকু বিষ্ময় জুড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি এরকম কথা বাচ্চাদের বলেছেন?
তিনি স্বীকার করলেন। আমি অন্তত তিনবার বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম "আপনি কি এধরণের কথা বলেছেন?"
তিনি "হ্যা" বললেন। এ পর্যায়ে আমি তাকে চেপে ধরলাম বললাম, ম্যাডাম আপনি আসলে সবটাই বলেছেন। আপনি বাচ্চাদের শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে অসুস্থ করে দিয়েছিলেন। এটি তিনি আবারও অস্বীকার করলেন।
বললাম, আপা আপনি একজন শিক্ষক হয়ে কিভাবে বাচ্চাদের বলতে পারেন রবীন্দ্রনাথের বোনের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে হয়েছিল? আপনি বাচ্চাদের বাংলা পড়ানোর যোগ্য নন।
তিনি ধাক্কা খেলেন কিন্তু বাকি কথাগুলো অস্বীকার করা অব্যাহত রাখলেন। বললাম,
আপনি যেহেতু অস্বীকার করছেন, তার মানে আপনি জেনে বুঝেই ছাত্রদের মিথ্যা বলেছেন। বিষয়টি সঠিক নয় –এটা আপনি জানেন; তবুও বলেছেন। আপনার মতো টিচার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকা উচিত নয়।
ততক্ষনে তিনি যথেষ্ট ভ্যাবাচেকা হয়ে গেছেন। এ পর্যায়ে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যগত তফাৎ সামান্য বোঝালাম। বললাম, রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন,
"আমার মাথা নত করে
দাও হে তোমার
চরণ ধুলার তলে"
তখন নজরুল লেখেন,
"বল বীর, বল উন্নত মম শির।"
আবৃত্তি করে দুই জনের কাব্যের সুর ও ছন্দের ভিন্নতা বোঝালাম।
রবীন্দ্র কবিতায় মুক্তির আকাঙ্খা দেখুন,
"কত দিন ভাবে ফুল
উড়ে যাবো কবে,
যেথা খুসি সেথা যাবো
ভারী মজা হবে।
তাই ফুল একদিন
মেলি দিল ডানা.... "
কতো ধীর, শান্ত ও স্নিগ্ধ এই মুক্তির আকাঙ্খা! কিন্তু নজরুলের মুক্তির আকাঙ্খা এমন:
"থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।"
নজরুল যেন সবকিছু ভেঙেচুরে বের হয়ে যেতে চাচ্ছেন। এই দুই মহাপুরুষের কাব্যধারা মিলবে কিভাবে? তাছাড়া এধরণের মিথ্যা দিয়ে কি কাজী নজরুলকে বড় করতে হয়? তিনি নিজ মহিমায় সমুজ্জ্বল, অনেক বড় – যে উচ্চতাকে ক্ষুদ্রবুদ্ধির মানুষ ছুঁ’তে পারেনা। তাই অকথ্য কথা রচনা করে।
ভদ্রমহিলাকে বললাম, কাব্য বিচারও দরকার নেই। দু'জনের বয়সের ব্যবধান কতো তা কি জানেন? রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বজয়ী তখন পর্যন্ত "কবি নজরুলের" জন্মই হয়নি। তখন তিনি অপ্রকাশিত প্রতিভার একজন মানব শিশু। রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তখন নজরুলের বয়স ১৪ বছর ৫ মাস। আর কিছু বলতে হবে?
আপনি জেনে হোক, বা না জেনে হোক এরকম চর্চা কেন করেন? ভদ্রমহিলা আবারও শ্রেণিকক্ষে এধরণের পাঠদানের কথা অস্বীকার করলেন। বুঝলাম তার দুর্বলতা অনেক ক্ষেত্রেই। সত্য প্রকাশেই তার দুর্বলতা।
বলাবাহুল্য, ঐ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি ঐ শ্রেণীকক্ষে (ষষ্ঠ শ্রেণী) উপস্থিত আরও তিনজন বাচ্চার সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেছি। কিছুক্ষণ পর প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিষয়টির জন্য দুঃখ প্রকাশ করায় এবং নীতিগতভাবে আমি কারও চাকরির ক্ষতি করতে অনিচ্ছুক হওয়ায় থেমে গিয়েছিলাম। আজও তার নাম পরিচয় তুলে ধরছি না।
তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এধরণের শিক্ষকরা আসলেই ক্ষতিকর। যে মানসিকতা থেকে তারা এরকম মিথ্যার চর্চা করেন তা সাপের বিষের চেয়ে মারাত্মক।
কবিকে নিয়ে মিথ এবং মিথ্যার চাষ কি সেখানেই শেষ? আপনারা যারা নজরুলকে খণ্ডিত করে দেখেন; যারা বলেন, মসজিদের পাশে কবরে শায়িত হওয়া কাজী নজরুলের শেষ ইচ্ছা ছিল তাদের কি বলা যায়? তাদের বলছি: আসলে প্রিয় কবির শেষ ইচ্ছে ছিল, তাঁর মরদেহ যেন জলের বদলে মদ দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হয় এবং শরাবখানায় কবর দেওয়া হয়। কথাটা মানছেন না?
তিনি লিখে গেছেন:
"যেদিন লব বিদায় ধরা ছাড়ি প্রিয়ে,
ধুইও লাশ আমার লাল পানি দিয়ে।।
শরাবী জামশেদী গজল ‘জানাজায়’ গাহিও আমার
দিবে গোর খুঁড়িয়া মাটি খারাবী ওই শরাব-খানার!”
একটি গজলের শেয়রে শরাবখানায় গোর দিতে বলার মধ্যে কিংবা আরেক গানের পঙতিতে মসজিদের পাশে কবর দিতে বলার মধ্যে কি কবির জীবনের শেষ ইচ্ছা আদৌ লুকিয়ে আছে? একজন কবির বহুমাত্রিকতা সবাই বোঝার চেষ্টা করুন।
তবুও যদি কবির সমগ্র সত্ত্বাকে দেখতে অসহ্য বোধ হয়; যদি খণ্ডিত করেই তাঁকে দেখতে চান, যদি নিজের ভাবনার অনুরূপ তাঁকে ভাবতে ভালবাসেন, তবে ভাবুন। অন্তত মিথ্যাচার দিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করবেন না।
আমার প্রাণের কবি নজরুলের ১২৩তম জন্মদিনে হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা, প্রণাম।

Comments

Popular posts from this blog

চোখেরজল -------সরওয়ার স্যার

অবিভাবক ছাড়া বিয়ে শুদ্ধ না হওয়ার ব্যাপারে কতিপয় হাদীস:

আজ ফরেক্স ওয়েবিনার XM এর সৌজন্যে